কথোপকথন
অমিতাভ মৈত্র এবং অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রথম পর্ব
অনুপম
সেই
ছেলেটাকে কি আজও নিজের মধ্যে কোথাও টের পান,
যে সূর্যাস্তের সময় একটা মাঠে দাঁড়িয়ে
প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঢিল ছোঁড়ার একটা আশ্চর্য খেলায় মেতে উঠত, যেখানে পরীক্ষাটা
জোরের নয়, সহ্যশক্তির, আর নিজের
রক্ত দেখার অভ্যাসের? যে ছেলেটা শীর্ণ হলেও প্রচণ্ড জোরে পেস
বোলিং করত, সেই ছেলেটা আজ আপনার মধ্যে কোথায়?
অমিতাভ মৈত্র
অমিতাভ মৈত্র
আছে। তার পুরনো জামাগুলো এখনও আমি মনে মনে খুঁজি। বর্ষার দিনে স্কুলে যাবার প্যান্ট (তখন তো জামা
কাপড় বেশি ছিল না) শুকোয়নি বলে যে ছেলেটি ইঁট দিয়ে গাঁথা
মাটির উনুনের গায়ে চেপে ধরে প্যান্ট শুকোনোর সময় কোনোভাবে পুড়িয়ে ফেলেছিল যৎসামান্য
অংশ এবং
আত্মক্ষোভে সবাইকে লুকিয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে সেই প্যান্ট পরে স্কুলে গেছিল -- ছাই রঙের সেই প্যান্টটা এখনও সে খোঁজে। বৈশাখ মাসের
গরমে তার রোগা পরিশ্রমী বাবা সরকারী কাজে এবড়ো খেবড়ো গ্রামের রাস্তায় পঞ্চাশ মাইল সাইকেলে
ট্যুর করে বাড়িতে সন্ধ্যায় ফিরে আসা বাবার নিঃশেষিত মুখ আর পায়ের ফুলে ওঠা শিরার দপ্
দপ্ আজও তার চোখে ভাসে। এবার “আমি” শব্দটা আসুক। ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত পরীক্ষায়
চলনসই ফল করার পর আমাকে পুরষ্কার দেবার পরিকল্পনা হত। শুনতাম আমাকে
দেওয়া হবে এক আশ্চর্য বই -- যার নাম আবোল তাবোল। বহরমপুরে তো এসব বই আসতো না তেমন। বইটা আমার
আর পাওয়া হল না কখনোই। সেই পরমাশ্চর্য বইটির প্রতিটি পাতার রুদ্ধশ্বাস
আনন্দ আমি মনে মনে ভাবতাম। স্বপ্ন দেখতাম বইটার। স্কুলের শেষধাপে পড়ার সময় এক বন্ধুর সৌজন্যে বইটি পড়ে হতাশ হলাম। আহ! এই
বইটির থেকে আমার স্বপ্নের সেই আবোল তাবোল কত ভাল ছিল!
কী
জানো অনুপম, আমি আগাগোড়াই একটু খাপছাড়া। নিজের সাথেই খেলা করতাম। নিজেকে নিয়েই
আমার পৃথিবী। যখন আমি দেড়বছরের আমার লিভারে বেশ ভালোমতো গোলমাল হলো। আমার ব্রেকফাস্ট,
লাঞ্চ, ডিনার তখন
ঘুঁটের আঁচে মাটির হাঁড়িতে পেঁপে আর হলুদ বাঁটা দিয়ে রান্না করা 'পোড়ের ভাত'। ঘুঁটের ধোঁয়ার গন্ধ ছিল একমাত্র মশলা। নুন বারণ। দুধ মাছ সব্জীর তো প্রশ্নই ওঠে না। দেড় থেকে
সাড়ে তিন বছর আমি শুধু এই খেয়ে বেঁচেছি। ডাক্তার বলেছিলেন পাঁচ বছর হলে আমি সিরোসিসে
মারা যেতে পারি। বড় হয়ে শুনেছি আমি কোনোদিন ওই একই খাবার খেতে অস্বীকার করিনি, কাঁদিনি। হয়ত এটাই আমাকে মোহহীন,
আসক্তিশূন্য এক শ্বাস-নেওয়া-যন্ত্র করে দিয়েছে সারাজীবনের জন্য। শৈশবের ওই দুই বছরের খাদ্যাভ্যাসের সৌজন্যে আজও আমি বিভিন্ন স্বাদের সূক্ষ ফারাকগুলো
বুঝতেই পারিনা। এমনকি সম্পূর্ণ লবনহীন কোনো খাবার দিলেও আমি খেয়াল করিনা সেটা।
দু’বছরে বয়সে পৌষপার্বণের দিন উঠোন জুড়ে আলপনা দিয়েছে পিসি। মা, দিদু, কাকিমা পিঠে
পুলি বানাতে ব্যস্ত। শুনেছি আমি ঘরে ঢুকে সবটা দেখে তাড়াতাড়ি
ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলাম নিস্পৃহ মুখে। কোনো বায়না করিনি। খেতে চাইনি। যেহেতু জানতাম আমার জন্য তৈরী হচ্ছে পোড়ের
ভাত যা আমার প্রাপ্য খাবার। বলা বাহুল্য, এসবই আমার
বড় হয়ে শোনা। আমার নিস্পৃহ উদাসীন সেই যাওয়া সহ্য করতে না পেরে দাদু আর দিদা
নিভিয়ে দিয়েছিল উনুন।
চার
বছর বয়সে আমার তীব্র ইচ্ছে হতো ভিক্ষুক হবার। একটা গেরুয়া
ঝুলি আর একটা একতারার বায়না করতাম মাঝে মাঝে। একদিন ছোটকাকু
ছেঁড়া একটা ধুতি গিরিমাটি দিয়ে রঙ করে বানিয়ে দিল ঝুলি। আর নারকেল
তেলের কৌটোয় কঞ্চি বেঁধে তার জুড়ে বানিয়ে দিল একতারা। শুরু হল আমার
ভিক্ষুক জীবন। পাঁচ সাতটা বাড়ি নিয়ে আমাদের পাড়া। প্রতি বাড়িতে
আমি ভিক্ষে করতে যেতাম পিসির কাছে শেখা
“ শোনো বন্ধু শোনো / প্রাণহীন এই শহরের উপকথা ” গাইতে গাইতে। গান শেষ হলে ঝুলি বাড়িয়ে দিতাম। আমার ভিক্ষালব্ধ
শুকনো পাতার স্তূপে ঝুলি ভরে উঠত। শুকনো পাতার ভিক্ষান্ন দেওয়ার পর সেই
সব বাড়ির মা জ্যেঠিমারা কোলে তুলে নিতেন আমাকে। অসুস্থ আমাকে
কোনো খাবার দিতে না পারার বেদনায় কারো কারো চোখে জল আসতে দেখেছি আমি।
সেই
ছেলেটা হয়তো এখন অনেক জলের নীচে চলে গেছে,
অনুপম। দেখা যায়না। অনুভবেও সহজে ধরা যায়না। তবু, আছে।
অনুপম
গায়ে কাঁটা দেওয়ার পক্ষে এই কথাগুলো যথেষ্ট। শিহরণ হল সেই ঘটনা যার গায়ে কোনো জীবাণু টেকে না। তাঁর এই 'খাপছাড়া' ছেলেবেলা না থাকলে আমরা অমিতাভ মৈত্রকে পাই না। পেতাম না। আওয়ার ম্যাচুইরিটি ইজ বেসড্ আপঅন আওয়ার চাইল্ডহুড। কিংবা, আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দ্যাখায়। বহরমপুর খুব সম্পন্ন
শহর, সাহিত্য সংস্কৃতির দিক থেকে। নিজস্ব কৌলীন্য
আছে তার। বহরমপুর মানে,
ঋত্বিক ঘটক, যুবনাশ্ব, রৌরব,
এইসব নাম দ্রুত মনে খেলে যায়। অমিতাভ মৈত্রর কবিজীবনকে এই শহর কেমনভাবে দিশা দিয়েছে, আকার দিয়েছে?
কেমন ছিল ছেলেবেলার বহরমপুর? অথবা,
বহরমপুরের ছেলেবেলাটা?
অমিতাভ
মৈত্র
একটা কথা বলি, অনুপম। আমি নিজের মুদ্রাদোষে নিজেই জব্দ। বহরমপুর আমার কাছে আর পাঁচটা শব্দের থেকে আলাদা কিছু নয় - মানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে। বিশেষ কোনো
গুরুত্ব, অন্তত এই ক্ষেত্রে, বহরমপুরকে দেবার কোনো মানে হয় না। যুবনাশ্ব, সেই দীর্ঘদেহী কালো চশমা আর সাদা ধবধবে পোষাকের মানুষটিকে কয়েকবার
দূর থেকে দেখেছি মাত্র। প্রাণী হল নামের একটা হাই প্রোফাইল ক্লাবে
বিকেলে মাঝে মাঝে ওঁকে বসে থাকতে দেখেছি। একজন খাঁটি মূর্খের মতো “কোমলগান্ধার”-এ “আকাশ ভরা
সূর্য তারা” গানের - ঐ যেখানে “ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি”
গাওয়া হচ্ছে, তখন অনিল
চ্যাটার্জীর পায়ের ক্লোজ আপে ঘাসের দুরমুশ হওয়ার দৃশ্য দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। মার শালাকে।
আমার বহরমপুর ছিল ট্রাকড্রাইভার মঙ্গল সিং, চায়ের দোকানের বীরেন,
বন্ধু বান্ধবদের সাথে উড়ে বেড়ানো, গাঁজার ধুমকি,
লালবাগ থেকে রাত করে গাঁজা খেয়ে ট্রেনের
লাইন ধরে বাড়ি ফিরে আসার বহরমপুর। মেয়েদের নিয়ে আমাদের কারোরই মাথা ব্যথা
ছিল না। প্রশান্ত
(গুহমজুমদার) একাই এসব নিয়ে ভাবতো টাবতো। আমরা ওকে
প্রেমের দারা সিং বলতাম। এক কনকনে শীতের ভোর চারটেয় চারদিক ঘুটঘুটে
অন্ধকারে প্রশান্ত এসে ডাকল আমাকে। সে আমলের ডাক্তারবাবুরা যেমন ‘কল’-এ বেরোতেন, আমিও তেমনি
বেরিয়ে এলাম। দুজনেই গম্ভীর আধমাইল দূরে হিন্দ ক্লাবের মাঠে একটা বড়ো পিচ রোল
করার লোহার রোলার এর ওপর চুপচাপ বসে পড়লাম
- কোনো পূর্বধারণা না নিয়ে এবং
প্রশান্তর নির্দেশ মেনে।
সে
যুগের সেই মারাত্মক ঠান্ডা,
বরফের মতো রোলার আমাদের কোমর থেকে পা
অব্দি অসাড় করে দিল মুহুর্তে। পরে জানলাম, মাঠের ওপারে
একটা বাড়ির দোতলায় অপর্ণা নামের একটি মেয়ে থাকে। সকাল সাড়ে
সাতটা নাগাদ কয়েক মিনিটের জন্য সে বারান্দায় আসে। যখন সে দাঁড়াবে
এসে, তার মুখে শীতের প্রথম রোদ্দুরটুকু দেখতে চায় প্রশান্ত।
এই আমার বহরমপুর,
অনুপম। কিছু মুখ
বদলে গেছে চল্লিশ বছরে। তবু আমার বহরমপুর আজও ঠিক আগের মতো। লেখা লেখির আড্ডায় আমি কোনদিনই থাকি না। সভা, উৎসব,
অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকি। এ সবের কোনো আকর্ষণ,
কোনো মূল্য আমার কাছে নেই। দিনে দুবার চায়ের দোকানে কলের মিস্ত্রি, মাংসের দোকানি- এরকম সহজ,
উত্তেজিত মানুষদের সাথে আড্ডা দিই। ব্যস্।
অনুপম
আপনাকে আলাদা করে কবিতা লিখতে হয় না। এই যে বলে গেলেন, এর চেয়ে বেশি বা কম কোনো কবিতাকে আমি চিনিনি, চিনতে চাই না। কিন্তু, তবু, সো কলড কবিতা
লিখতে শুরু করলেন, কীভাবে? প্রথম কবিতাটা
মনে আছে? প্রথম কাকে কবিতা পড়িয়েছিলেন? একটা গল্প শোনার আশা করছি আর কি, আপনার ব্যক্তিগত
কাদম্বরী দেবীকে খুঁজছি না মোটেই।
অমিতাভ মৈত্র
অমিতাভ মৈত্র
কবিতা আমি কখনও
লিখেছি কি? যা
লিখি, কবিতা হিসেবে যা পাঠককে এগিয়ে দিই, সেগুলো কবিতা
কিন্তু নয়! আমার এটা শক্ত বিশ্বাস, অনুপম!
তবু কবিতা হিসেবে এগুলোই পড়েন কেউ কেউ- ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় কিরকম।
স্কুলে পড়তে পড়তে পাঠ্য কবিতার জঘন্য প্যারোডি লিখে লুকিয়ে রাখতাম খাতা। কিরকম প্যারোডি? রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা পাঠ্য ছিল। কবিতার নাম কি 'প্রতিদান'? প্রথম লাইনগুলোছিল এরকম-
স্কুলে পড়তে পড়তে পাঠ্য কবিতার জঘন্য প্যারোডি লিখে লুকিয়ে রাখতাম খাতা। কিরকম প্যারোডি? রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা পাঠ্য ছিল। কবিতার নাম কি 'প্রতিদান'? প্রথম লাইনগুলোছিল এরকম-
"একদা প্রভাত কালে সিতারার দুর্গভালে
শিবাজী হেরিলা একদিন..." ইত্যাদি...
এত মুগ্ধ করল কবিতাটি, প্রাণের আনন্দে একটা প্যারোডি বানালাম। এক ভন্ড বদমাশ গুরুর মেয়েদের হাতে হেনস্থা নিয়ে। সবটা এখন আর মনে নেই। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এক জায়গায় ছিল -"গুরু চলেছেন গেয়ে/....../ হে ভবেশ হে শঙ্কর সবারে দিয়েছ ঘর/ আমারে দিয়েছ শুধু পথ/ অন্নপূর্ণা মা আমার লয়েছে দুঃখের ভার/ সুখে আছে সর্ব চরাচর/ মোরে তুমি, হে ভিখারি, মার কাছ হতে কাড়ি/ করেছ আপন অনুচর!" ইত্যাদি। সবকিছুই আমার স্মৃতি নির্ভর। পুরনো স্মৃতি পুরোনো জুতোর মতই ঝুঁকিসঙ্কুল। তো এই অংশটা যেভাবে লিখেছিলাম তা এরকম-
"গুরু চলেছেন ধেয়ে পশ্চাতে
অজস্র মেয়ে
লাঠিসোটা নিয়ে করে তাড়া।
প্রাণে তার বড় ভয় প্রহারেণ ধনঞ্জয়
হতে হবে যদি পড়ি ধরা।
পায়ে বল কমে আসে ছোটে
গুরু উর্দ্ধশ্বাসে
কাঁধ থেকে খসে পড়ে ঝোলা।
তৃষ্ণায় শুকায় বুক ভাবে গুরু,
হত সুখ
পেলে এক গ্লাস কোকাকোলা।"
কবিতা পড়ে আমার বোন স্কুলে ওর বন্ধুদের পড়াল। তারা খাতায় টুকে নিল সেটা। এপর্যন্ত ঠিকঠাক। কিন্তু একদিন দিদিমণির সামনে বোনের এক বন্ধু রবীন্দ্রনাথের মূল কবিতাটি ভুলে গিয়ে আমার লেখাটির লাইনগুলো তোৎলাতে তোৎলাতে বলে যায় সভয়ে। গার্জেন কল হয়। আমার কবিতার প্রথম পাঠক এই মেয়েটি। আমার কবিতার প্রথম শহীদ!
কলেজে উঠে ইংরেজিতে কিছু কবিতা লিখলাম। ঝগড়া করতে করতে বেসামাল এক বুড়োর মুখ থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়া দাঁতের পাটি নিয়ে অয়ামবিক পেন্টামিটারে লিখলাম আমার প্রথম দীর্ঘ কবিতা। এসব লেখা কেউ পড়েনি অবশ্য। জানতাম কাজটা খারাপ।
এরকম সময়েই আমি আর আমার বাল্যবন্ধু প্রশান্ত মজুমদার পরস্পরের কাছে আমাদের গোপন পাপের কথা স্বীকার করি- কবিতা পড়া ও লেখার চেষ্টার কথা। লিখি দুজনে, পড়ি দুজনে। আর হ্যাঁ, অনুপম। কোন কাদম্বরী দেবীই কোনদিন ছিলেন না আমাদের করুণ ফিচেল গল্পে।
অনুপম
হা হা, সে তো ঠিকই আছে। আমিও আপনার কবিতার শহীদ। প্রশান্ত গুহমজুমদার এই সাক্ষাৎকার পড়বেন। প্রশান্তদা চমৎকার কবিতা লিখেছেন এই সংখ্যায়। আজ যখন আমরা খুব সহজে কবিদের বন্ধুত্ব হারাতে দেখছি, বহরমপুরের সেই দুই কিশোরের সম্পর্ক আলো ছড়াচ্ছে। কিন্তু ছেলেবেলায় কোন
কোন বই বা লেখক প্রিয় ছিলেন?
তাঁরা কি আজও প্রিয়? কৈশোর থেকে তারুণ্যে,
এবং যৌবনে প্রিয় লেখকদের তালিকা কীভাবে
বিবর্তিত হল?
অমিতাভ মৈত্র
অমিতাভ মৈত্র
১৯৫৫-৬০ সালের সাপ্তাহিক দেশ বই করে বাঁধিয়ে রাখতেন প্রশান্তর মা। সেখানে ‘আনন্দ বাগচী’ আর ‘বটকৃষ্ণ দে'র’ কবিতা মাঝেমাঝেই পেতাম। জীবনে প্রথম "দেশ" কিনলাম ৫০ পয়সায়। ১৯৬৮ সাল। সেখানে পড়লাম এক পাতা জুড়ে একটিই কবিতা
- "চন্দন কাঠের বোতাম"। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতাটি কয়েক মাসের জন্য তছনছ করে দিল
আমাকে। ঐ ভাষা,
ঐ প্রকাশ, সেসময়ে আমার
ধারণার বাইরে ছিল। কলেজের ছাত্র। বই কেনা সম্ভব ছিল না। তাই স্টলে দাঁড়িয়ে বারবার করে পড়তাম শক্তি, সুনীল,
তারাপদ, প্রণবেন্দু, রত্নেশ্বর,
পবিত্র - এঁদের মত
কবিদের লেখা। প্রথম সূর্যের আলো নামার বিস্ময় কোন পিঁপড়ের কাছে যেভাবে আসে সেই
বিস্ময়ে আমি কবিতা পড়তাম তখন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ৩ টাকায় কিনলাম "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা।" ম্যাগাজিন
কর্ণারের তুলুজ লোত্রেকের মত মানুষটিকে জ্বালিয়ে মেরেছি বইটা আনিয়ে দেবার জন্য। ভীষণ ভীড়ের ট্রেনে জায়গা পাওয়ার মত অনুভূতি হল বইটা পড়ে। মনে হল এই কবিতা সম্পূর্ণ অন্যরকম। কবি অলোকনাথ
মুখোপাধ্যায় তখন একদম ভাস্করের ভাষায় কবিতা লিখতেন। এঁকে দেখেই
বুঝলাম ভাস্কর আসলে ময়াল সাপের মতো। চিতা, সিংহ বা বাঘের
মত পিছনে ছুটবে না। পাঠককে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসতে দেবে - তারপর কী হবে তা জানে শ্যামলাল! হা হা!
কী জানো অনুপম, যে কবিতা একবার বিস্মিত করে, সে কবিতা বিশ্বস্ত বন্ধুর মত সারাজীবন তোমার সাথে থাকবে। তোমার ভাল করবে। একটা চারলাইনের কবিতা মনে রাখতে পারলে সারাজীবন কত নতুন সব আলো ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি সেই কবিতা থেকেই।
আমি যাদের কবিতা প্রথম জীবনে পড়তাম, পরে অনেক নতুন মুখ তাদের পাশে এসেছে। এছাড়াও, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ আর নাটকও পড়তাম। সুনীল, বিমল কর, শীর্ষেন্দু, মতি নন্দী, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিতের সাথে খাপছাড়াভাবে দেশবিদেশের গল্প উপন্যাস এইসব। আমার দৃষ্টিশক্তি ঠিক করে দিয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ। ভাষার ঐ লাবণ্য ও ঝংকার- ভাবা যায় না!
অনুপম
দারুণ লাগল অমিতাভদা। সারা জীবন কি একটা কবিতার জন্য যথেষ্ট, নাকি একটা জীবন সারা পৃথিবীর কবিতার তুলনায় খুব কম পড়ে যায়? বুদ্ধদেব বসুর গদ্য আমার কাছেও বিস্ময়কর, ও শিক্ষণীয়। যেমন আপনার স্মৃতিশক্তি
আমার কাছে বিস্ময়কর। এই যে অন্যদের অসংখ্য দুর্দান্ত কবিতা, দুর্ধর্ষ পংক্তি মনে রাখতে পারা, এটা কবি হিসেবে
আপনার নিজের কেমন লাগে? ভালো স্মৃতিশক্তি কবি হওয়ার জন্য অপরিহার্য, কেউ কেউ এটা নাকি বলেছেন, এবং আমাকে তো এককালে সন্ত্রস্ত করেছেন। আমার স্মৃতিশক্তি জঘন্যরকমের লজ্জাজনক। এই সাক্ষাৎকার যে ঘটছে, সে ব্যাপারে আমাকে খুব সাবধান হতে হচ্ছে। আমি অনেক কিছু ভুলে যাই, আপনি বহু কিছু মনে রাখেন।
অমিতাভ মৈত্র
অমিতাভ মৈত্র
প্রত্যেকের স্মৃতির
জায়গাই সমান জোরালো। যদি তুমি বিস্মিত হবার প্রতিজ্ঞা না করে
থাকো, তবে কিন্তু স্মৃতিশক্তির মধ্যে বিস্ময়কর কিছু নেই। ভাবো একজন দাবার গ্র্যান্ডমাস্টার- কত হাজার
সম্পূর্ণ খেলা ( শুধু চাল নয়)। কিছু একটা ভাল লাগলে তখন কয়েকবার পড়লে
সেটা মনে থেকে যায়। যখন সবে কবিতায় ডুবছি তখন তো বই, পত্রিকা, এসব কেনার টাকা থাকত না। তাই এক জ্যান্ত
আকর্ষণে প্রিয় লেখাটি দোকানে দাঁড়িয়ে কয়েকবার পড়তাম। মুহূর্তের
সেই মগ্ন পাঠের ইনটেনসিটি বোধহয় সারা জীবন মনে পড়িয়ে যায়।
এসব কোন ব্যাপার না। তবে একটা ভাল দিক আমি দেখেছি এই মনে রাখার ক্ষমতার। আমাকে সারাজীবন চলমান থাকতে হয়েছে আমার চাকরির সৌজন্যে। সেই একঘেয়েমি ও ক্লান্তির সময়ে অসংখ্য কবিতা - কখনও সম্পূর্ণ, কখনও আংশিক - আমাকে মেধাবী সঙ্গ দিয়েছে। আরো অসংখ্য কবি এভাবেই বাঁচেন। আমার কোথাও কোন কৃতিত্ব নেই। কবিতা লেখার জন্য ভাল স্মৃতিশক্তি অপরিহার্য এটা কারা বলেন আমি জানি না। ধরা যাক আমি রঁদ্যার "গেটস অফ হেল" এর ওপরে দান্তের চিন্তিত মুখ ( The thinker) এর একটা রেপ্লিকা দেখলাম। সেই রেপ্লিকা তো আমি আমার ছোট্ট বাড়িতে আনতে পারি না। বা ঐ মূর্তির অনুকরণে বসে থাকা অভ্যেস করতে পারি না।
(চলবে...)
লেখায় নীরবতা সবচেয়ে বড়ো ডানা
ReplyDeleteপ্রথম অংশ বড় বেশি স্পর্শ করল। ভাল লাগছে। পরের অংশের অপেক্ষা
ReplyDeleteনিজের চলমানতার ওপর দাগ রেখে দিল এই কথোপকথন
ReplyDeleteচমৎকার কথোপকথন। অনেক কিছুই শিখিয়ে দেয়। বুঝতে সাহায্য করে নিজেকেও।
ReplyDeleteএকজনের মাঝে অনেক পরিচিত মুখের দর্শন মিলেছে।অমিতাভ মৈত্র শরৎ এর বাংলার আকাশ হয়েছেন। দুজনের জন্যই শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteঅপূর্ব
ReplyDelete