তৃতীয় পর্ব
কোন অবস্থাতেই ঠোঁট ও কলম যেন বেঁকে না যায়
কবিতা তখন পুরোদমে চলছে। ছোটদের বিভিন্ন কাগজ
শিশুসাথী মৌচাক সন্দেশ রামধনুতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর কবিতা। পাশাপাশি চলছে নানারকম ভাবনা। দু একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন কাগজে ।নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতি যখন
বিপন্ন হয়ে পড়ে তখন লেখালেখির চেয়ে রাস্তার খোঁজার কাজই হয়ে পড়ে প্রাথমিক কর্তব্য। এই দায় সকলের অন্তর থেকে উঠে আসে ।জোর
করে চাপানোর দরকার হয় না। তাই প্রতিবাদে সরব
সবাই ।গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন।বোকারো,চাষ, চন্দনকিয়ারী থেকে পটমদা চারদিক উত্তাল। ঘন সংবদ্ধ
মানুষেরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে আবেগের দোলায় যেন সমুদ্রের খণ্ড খণ্ড ছবি।টুসু সত্যাগ্রহের
মধ্য দিয়ে টুসুগানের সুরে সুরে এক অপূর্ব বন্ধনে আবদ্ধ সারা জেলা।জেলার বিভিন্ন
অঞ্চলের লোককবিরা টুসুগানের সুরে এবং প্রতিবাদের মুর্ছনায় গানকে এরকম ভাবে মাটির
সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন যে তা রোমাঞ্চ তৈরি করে বুকে।এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সঙ্গীতের
মতোই কবিতাও তো এরকমই হওয়া উচিত যা স্পর্শ করবে উত্তোলিত হাত যা ছুঁয়ে যাবে বুকের বারান্দা।শব্দের মায়াবী
আলোয় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাবে মানুষ।আর উচ্চারণের ভেতর থাকবে জীবনের অনিবার্য
ঘোষণা।বুদ্ধির ফিতে দিয়ে এই আবেগকে মাপা যাবে না কোনদিন। বাবার মনে সেদিন এই কথাগুলোই দোলা
দিয়েছিল।পরবর্তীকালে বিভিন্ন কবিতার মধ্যে এই জাগরণের ধ্বনি টুসু ভাদুগানের লোকায়ত
দিকগুলি প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে মুখরিত হয়েছে।
এদিকে দাদুর তখন চাকরি নেই। বরখাস্ত করা হয়েছে
চাকরি থেকে। টিউশন পড়িয়ে অতিকষ্টে দিনযাপন করছেন। ছটি ছেলেমেয়ে আরও দুজন ভাগ্নে ভাগ্নির দায়িত্ব তাঁর মাথায়।তবু অবিচল।কোনমতেই মাথা নোয়াতে
রাজি নন তিনি । মাঝে মাঝে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে জেলহাজতে
পাঠানোর হুমকি আসছে। কেউ কেউ এমন পরামর্শও দিচ্ছেন জলে বাস করে কুমীরের সাথে বিবাদ করার পরিনতি
অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।দিনকাল খুব খারাপ যেকোন সময় জেলহাজতেও ভরে দিতে পারে। তবু বেপরোয়া।
বিহার সরকারের দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে
কংগ্রেস তখন নিস্ক্রিয়। ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের যুক্তিসম্মত দাবিকেও তাঁরা মেনে
নিতে রাজি নন। কেউ কেউ দ্বৈতশাসনের কথাও বলছেন ।অর্থাৎ মানভূম জেলা বিহার এবং বাংলা দুটো রাজ্যের শাসনসীমার মধ্যেই
থাকবে। এরকম হলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না বরং আরও নতুন নতুন বিড়ম্বনা তৈরি হবে।
কংগ্রেসের সুবিধাবাদী অবস্থানের
বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে স্বয়ং অরুণচন্দ্র
ঘোষ মানভুম জেলা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে
এলেন। তাঁর সাথে আরও ৪০ জন প্রতিবাদী সদস্যও বেরিয়ে এলেন। এঁদের নিয়ে তিনি নতুন দল
গঠন করলেন- লোকসেবক
সঙ্ঘ । ব্যবস্থাপক হিসেবে বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত,
মানভূম জননী লাবণ্যপ্রভা ঘোষ , ভজহরি মাহাত,অরুণচন্দ্র ঘোষ,এবং বিপ্লবী অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী
প্রমুখের নাম ঘোষিত হল। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ।আকাশ মুখর বাতাসে প্রতিবাদের ধ্বনি। কিন্তু এই
ধ্বনিকে শুধু মানভুমের সীমানায় আবদ্ধ রাখলে চলবে না । দিল্লীর দরবারে
একে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন ভজহরি মাহাত। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারন নির্বাচনে
তিনি প্রার্থী হলেন দক্ষিন মানভুম কেন্দ্রে। প্রত্যেক গ্রামে তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরলেন। আমাদের গ্রামেও
এসেছিলেন।আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলেন সবার কাছে।এই নির্বাচনে বিশাল জনসমর্থন নিয়ে জয়ী হলেন তিনি। বুঝতে পারলেন
ভাষার আবেগ সারা জেলার মানুষের মনে সমুদ্রের জোয়ারের মতো আছড়ে পড়েছে। এই আবেগ তাঁর
মধ্যেও গলন্ত লোহার মতো ফুটছে। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমেই বললেন আমি ইংরেজি
জানিনা। হিন্দির বিরুদ্ধে আমার লড়াই তাই সংসদে দাঁড়িয়ে আমি হিন্দিতেও ভাষণ দেব না।
আর কইলকাত্তার বাবু লকদের পারা উ চিকন ভাষাটাও আমি জানিনা। আমি মানভূইয়া
লোক।মানভূমের টাইড় ভাষাতেই আমি আমার জেলার মানুষের দাবি তুইলে ধইরব্য। সেই
ঐতিহাসিক বক্তব্য সারা জেলার মানুষের লড়াই এর উত্তেজনাকে কয়েকশগুণ এগিয়ে
দিয়েছিল।
শুধু সংসদে নয় তার বাইরেও সারা জেলায় মাতৃভাষার
আবেগকে সামনে রেখে সারা তখন সমস্ত মানুষকে
বিহার সরকারের বিরুদ্ধে সচেতন করার কাজ চলছে । অরুণচন্দ্র ঘোষ একদিন নিজে এলেন আমাদের
বাড়িতে। আমার বড়দাদু বনমালি গঙ্গোপাধ্যায় ( বাবার জেঠু, তিনিও বিহার সরকারের
আদেশের বিরুদ্ধে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন ) এর কাছে তিনি উঠেছিলেন।সঙ্গে আরও তিন
চারজন লোকসেবক সঙ্ঘের কর্মী।দাদুর কাছে এলেন দেখা করতে, বললেন – আপনাদের মতো
শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে সামনের সারিতে। স্থানীয় মানুষদের বোঝাতে হবে । অনেক
দায়িত্ব আপনাদের মাথায়। মুক্তি পত্রিকার পাতায় আমরা এসব লিখছি।মানুষ পাশে আছে।সাধারণ আনপড় মানুষের কাছে সারা
জেলার ভাবনাকে নিয়ে যেতে পারেন কেবল আপনারাই যারা শিক্ষক, যারা জাতির মেরুদন্ড।
তারপর বাবার কাছে এগিয়ে এসে বললেন
– তুমিই মোহিনী ?চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তেজ আছে। বুকের মধ্যে বারুদ আছে। এমন
বিক্রমের কবিতা তোমাকেই মানায়।আরও লিখে যাও আঁতাতবিহীন অগ্নিতাপে বেরিয়ে আসুক
দূর্বার কবিতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
তারপর আলোচনা হয় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে।বিভিন্ন
কর্মসূচিও নেওয়া হয়। সাতুড়ি থানার কড়াডাঙ্গার মাঠে এক ঐতিহাসিক জমায়েতের মাধ্যমে সরকারকে বার্তা দিতে
হবে। শুধু একটা জায়গা নয় জেলার বিভিন্ন প্রান্তেই এরকম জমায়েতের সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয়।সরকারের গুপ্তচরেরও অভাব নেই। তারা এইসব গোপন সভার সমস্ত তথ্য ফাঁস করে সরকারের
কাছে বাহবা এবং আর্থিক সুবিধা পেতে চায় তাই তাদের থেকে সচেতন থাকতে হবে ।
কড়াডাঙায় ঐতিহাসিক অনশন এবং
সত্যাগ্রহে আরও অনেকের সাথে দাদুর হাত ধরে বাবাও এসেছিলেন । দেখেছিলেন ভাষার কি
জোর ? অক্ষর কত শক্তিশালী হতে পারে । এক একটি গান উচ্চারিত হচ্ছে বাতাসে আর তুমুল
আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে মানুষের মনে।
‘’বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষারে
ও ভাই মারবি তোরা কে তারে
এই ভাষাতেই কাজ চলেছে সাত পুরুষের
আমলে
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে মুখ ফুটেছে মা বলে । ‘’
এই গান শেষ হলে
মানুষের সমবেত সঙ্গীতে মুখরিত হচ্ছে টুসু গান –
‘’ বাংলা গানে টুসু আমার মকর
দিনের সাকরাইতে
টুসু ভাসান পরব টাড়ে টুসুর গানে
মন মাতে ।‘’
জনবহুল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে একজন কবি উপলব্ধি
করছেন বাঘের থাবার নীচে ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত সময়। এই রক্তক্ষরণ অন্তরের রক্তক্ষরণ। প্রকৃত
স্বাধীনতার লড়াই। নিজস্ব ভাষায় কথা বলবার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, শিক্ষার
স্বাধীনতা। যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার স্বাধীনতা। একজন নক্ষত্র
পুরুষের শিরদাঁড়া টানটান রাখার জন্য শক্ত মেরুদণ্ড চাই আর চাই সেই ঠোঁট ও কলম যা
কখনও কোন অবস্থাতেই বেঁকে যাবে না ।
-----
উদ্ধৃত গানদুটি মানভূম ভাষা
আন্দোলনের প্রাণপুরুষ অরুণচন্দ্র ঘোষের লেখা ।
No comments:
Post a Comment