ইস্রায়েলের হিব্রু ভাষার কবি ড্যানিয়েল ওজ-এর কবিতা
পাঠ ও ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি, সঙ্গীতশিল্পী ড্যানিয়েল ওজ-এর জন্ম
১৯৭৮-এ। ইস্রায়েলের জনৈক
সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারীর মতে, এক বিদ্ঘুটে
বেয়াড়াপনা আছে ওঁর মধ্যে, যার মধ্যে কনুইয়ের
গুঁতো দিয়ে এগিয়ে যাবার প্রবণতা নেই। যার ফলে প্রথম
বই বের করতেই ওঁর পাঁচ বছর লেগে গেছিল। পড়াশোনা
করেছেন দর্শন ও সঙ্গীত নিয়ে।
২০১৩ সালে
প্রকাশিত ওঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ Shiiray ahava (Remnants of Love) নিয়ে
আলোচনা করতে গিয়ে কবি শাহার মারিও বলছেন, ওজ
এমন এক ভাষা নিয়ে ব্যাপৃত থাকে, যেন সে এক আত্মগোপন। ওঁর প্রথম বইতে ভাষার এমন এক
দুরূহতায় জোর দিয়েছিলেন, সাধারণ সংযোগ নির্মাণও যেন তাঁর উদ্দেশ্য নয়। আরেকটা বইতে
কাজ করলেন ভাষার স্বচ্ছতা এবং ব্লকেজ নিয়ে। দ্বিতীয় বইতে একুশ শতক এবং দ্বাদশ
শতকের ভাষার মধ্যে এক টানাপোড়েন দেখালেন ওজ।
সমালোচক ঈলান বার্কোইৎজ ‘হারেৎজ’ পত্রিকায় ওজের তৃতীয় বই Madua lo tiruny
beh-drakhim (Further up the Path) নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলছেন, ওঁর
কবিতার বিমূর্ততা এবং নিও-সিম্বলিজম ইস্রায়েলের সাম্প্রতিক কবিতার হট-ট্রেন্ড, যা কি
না দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি থেকে উঠে আসা, তার বিপ্রতীপে জেগে আছে।
ওঁর কয়েকটি কবিতা এখানে অনুবাদের চেষ্টা করলাম। প্রথম কবিতাটি ২০১৬-য়
লেখা। পরেরগুলো ওঁর তৃতীয় বই Further up the Path থেকে নেওয়া। এই লেখাগুলি
মাইক্রোফিকশন বা গদ্য-কবিতা মূলক। ওজ এগুলোকে বলছেন ফ্ল্যাশ
ফেবল।
গ্রন্থপঞ্জীঃ
The Earthly Life, ২০১০
Remnants of Love, ২০১৩
Remnants of Love, ২০১৩
Further up the Path, ২০১৫
বেদানার রক্ত
একটার পর একটা বীজ
তুলে নেওয়া হয়েছে বেদানার থেকে
ফলের রক্ত ছড়িয়ে যেতে
দিলাম টেবিল ক্লথের মতো
ঘাসের ওপর ছুরি পড়ে
গেছে, ইতিমধ্যে সতর্কতায়
বাবা-মায়েরা যাতে কথা
বলতে পারে ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে লুকোচুরি খেলতে।
তারা ঘুরে যাচ্ছে
আঙুরক্ষেতে আর এই উপবনে
প্রত্যেকটা গাছের পাশে
গিয়ে দেখছে
লুকোনোর কোনও জায়গা
নেই
অসীম এই বেদানার বীজ
আর এরকম সময়ে আঙুরের
ডালে ডালে অসীম আঙুর
স্মৃতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে
ক্যানসারের কোষের মতো
বউল গেঁজিয়ে নাকে তার
পচা গন্ধ
মাছি ভনভন করে যাচ্ছে
এখনও সূর্য আছে আর ঝিঁ
ঝিঁ পোকারা অহেতুক প্রস্তুত করছে তাদের ঘড়ি
ক্যানভাসের কাগজের মতো
ছেলেবেলার ওপর ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে এই গ্রীষ্ম
এই গ্রীষ্ম লুকিয়ে
রাখছে সব ছেলেবেলা
যেভাবে রুমাল ভিজে যায়
ক্লোরোফর্মে
(রচনাকাল – ২০১৬)
পথের ওপারে
(‘ফারদার আপ দ্য পাথ’
কাব্যগ্রন্থ থেকে; প্রথম প্রকাশ – ২০১৫)
বেড়ালের স্বপ্ন
বেড়ালের স্বপ্নের
ভেতর, কুরে কুরে খাওয়া মাছের কাঁটা, মাংস, আর কানকোগুলো যেন হাই তোলে যত তারা
জীবনের সাথে উদ্গত হয়। সেই জীব তখন পাখনা নেড়ে নেড়ে দ্রুত সাঁতরে ওঠে নদীর ওপরে।
পাহাড়ের নীচে যখন সে পৌঁছায়, মাছ তখন ক্লান্ত, ফুলে উঠেছে, স্রোতের টানে ভেসে এসে
পড়েছে নদীর তীরে। সেখানে নুড়িপাথর, শিলাগুটির ওপর এসে পড়েছে সূর্যের আলো, ঢুকে
যাচ্ছে বন্ধ চোখের পাতার ভেতর। চড়া আলোতে ঘুমের ভেতর বেড়াল গা ঝাড়া দেয় অল্প। ধীরে
ধীরে, মাছ পচতে শুরু করে।
টুপিওয়ালা
একবার আমি এক টুপিওয়ালার কাছে গিয়ে তার হাতে
আমার ছিঁড়ে যাওয়া ফেল্টের টুপিটা দিলাম। দাঁড়াও, সে বলল। টুক করে টুপিটা একটা
লাঠির ওপর রেখে কী একটা তাপ্পি দিল। তারপর নিজের মাথায় পরে নিল। টুপির কোঁচকানো
কানার ছায়ায় ঢেকে ছিল তার মুখ, আমি দেখতে পাইনি। ‘একদম নতুনের মতো’, সে বলল, ‘কী?
তাই না?’ ‘একেবারে’, আমি বললাম। এরপর সে স্যুইচ টিপে তার টেবিল ল্যাম্পটা
জ্বালালো। আর সেই আলোতে, আমি দেখলাম, সে কোনও টুপিওয়ালাই নয়।
দ্য ব্যুরো অব কার্টোগ্র্যাফি (মানচিত্র
অধিকর্তার করণ)
একদিন এক পর্যটক মানচিত্র দপ্তরে এসে বলল তারা
যেন তাদের ম্যাপটাকে এবার আপডেট করে নেয়, কেননা সে এক নতুন সমুদ্র আবিষ্কার করেছে।
শুনে, একজন সিনিয়ার অফিসার টোকো মুখ করে তাকাল, আরেকজন চোখ গোল গোল করে নাক কুঁচকে
রইল, যেন তার এখুনি হাঁচি হবে; তারপর মুখের ডানদিকে একটা অবজ্ঞার হাসি রেখে দিল।
ভুরু কোঁচকানো এক সেক্রেটারি বলল, ‘ফালতু যতসব — সবকটা সমুদ্রই আবিষ্কার হয়ে গেছে’। ‘আমার প্রমাণ হল’, পর্যটক বলল, ‘আমি সেই সমুদ্রে চান করে
এসছি’। ‘তাই-ই যদি হয়’, দপ্তরের
লোকেরা বলল, ‘তোমার গা শুকনো কেন? কেন সেই সমুদ্রের জল তোমার চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা
পড়ছে না?’ ‘সত্যিই তো!’ সে একটু ঠাট্টার ঢঙে বলল, ‘তবে সমুদ্রটা তো এখান থেকে অনেক
দূরে, আর অবশ্যই এতটা রাস্তা আসতে গিয়ে গা শুকিয়ে গেছে’। ‘মহাশয়’, অফিসাররা তাকে
বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই এরকম আশা করেন না যে কোনো ছোটলোক হাতে একটা পাথরও না নিয়ে এসে
বলবে যে সে একটা নতুন টিলা আবিষ্কার করেছে আর আমরা সেটা বিশ্বাস করব। কিম্বা একটা
নতুন জঙ্গল সে আবিষ্কার করেছে যেখানে একটাও পাতা নেই?’ পর্যটক তখন বাইরে একটা
টিউকলের দিকে দৌড়ে গেল, এক বালতি জল ভরে নিজের মাথায় ঢেলে ফিরে এল মানচিত্র
দপ্তরে।
জিন পরা ঘোড়া
ঘোড়াটা মাথা নাড়িয়েই যাচ্ছিল আর ঝাঁকাচ্ছিল,
কিন্তু মাছিগুলোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারল না যারা তার চোখের জল চুষে চুষে
খাওয়ার জন্য জ্বালিয়ে মারছিল। মুখের কোণে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরা একটুকরো জিনিসটার
থেকে যে ব্যথাটা হচ্ছে তার সঙ্গে সে এখন অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে, ক্বচিৎ হয়তো খেয়াল
করছে তা। কিন্তু ওখান থেকে কষ বেরিয়েই যাচ্ছে, ঘোড়াটা জানে না কী করে এটা থামাবে।
রাতে তার জিন আর লাগাম খুলে রাখা হল, মাছিগুলোও উড়ে গেল অন্ধকারে আর ঠান্ডায়। এরপর,
ঘোড়াটা বুঝতেই পারল না সে আদৌ কাঁদছিল কী না।
No comments:
Post a Comment