বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত



চতুর্দশ পর্ব

তুমি আমার গানের শরীর হবে/ভীড়ের কোণে গুটিয়ে থাকো তুমি
এই প্রবাসে তোমার মুখে আমি/দেখি আমি আমার জন্মভূমি
হয়ত তুমি ভীড়ের মধ্যে থাকো/অনেক মানুষ অনেক রকম মায়া
এক-এক ঝলক ঘরে ফেরার স্রোতে/ক্লান্ত শ্রান্ত কালো মুখে ছায়া
মৌসুমী ভৌমিকের গান 

গৃহীত অন্ধকারেই পথনির্দেশ রচিত হবে
ডানকুনিতে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে আজ নক্ষত্র সমাবেশ। এসেছেন মার্কেজ। নবারুণ ভট্টাচার্য। ঋত্বিককুমার ঘটক। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সন্দীপন তো আছেনই। আখতারুজ্জামানেরও আসার কথা। অরুণেশকেও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু উনি সদর্পে জানিয়েছেন কলকাতাকে বয়কট করছেন তিনি। বার্তা পাঠিয়েছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। এসেছে মার্কেজের সন্তান সেই বাজপাখিটিও, যার নাম চে। ছাদের কার্ণিশে বসে আছে। লক্ষ রাখছে চারপাশের ওপরঅনাকাঙ্খিত বা হুলিগান কাউকে এদিকে আসতে দেখলেই কেলিয়ে ফুলকপি বানিয়ে দেবেঅসুস্থ শরীরে অমিয়ভূষণ আসতে পারবেন না বলে বাংলা তথা কলকাতার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগৎ সম্পর্কে ওঁর অভিমত পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। মার্কেজ নিজে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। সেই বার্তাই পাঠিয়েছেন অমিয়ভূষণ। খাটের ওপর পা তুলে বসে কোলের কাছে একটা বালিশ টেনে কাটা কাটা উচ্চারণে সেটা সবাইকে পড়ে শোনাচ্ছেন সন্দীপন।
‘‘আসলে আমার বিশ্বাস কলকাতা নামক ঔপনিবেশিক শহর ও কনজুমার গুডসের আড়তের বাইরে মেদিনীপুর থেকে বীরভূম, পুরুলিয়া থেকে নদীয়া সীমান্ত, উলবেড়ের উত্তর থেকে সিকিম সীমান্তে ছড়ানো কলকাতার বাইরের যে ভূমি যাকে তোমরা গ্রামবাংলা বলো (কেন যে বলো? কোন সমাস এটা? কী কুৎসিত শব্দ!) যাকে প্রকৃতপক্ষে হিন্টারল্যান্ড ভাবা হয়, যেখানে দলদলে কাদায় পা পুঁতে দাঁড়িয়ে, ভালুক-ভালুক চেহারার কালো কালো কৃষকেরা ঔপনিবেশিক শহরের অন্ন তৈরি করে, তথাকথিত ডিয়ারনেস অ্যালাউন্সের যোগান ঠিক রাখে, যে-ভূমিতে নীল বিদ্রোহ, চাষী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, যে-ভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবস্থান পাতেন, সেই ভূমি যা কলকাতার চাইতে অনেক অনেক বড়ো, সেখানে বাঙালিদের দশ ভাগের সাত ভাগ থাকে, সেই আমাদের মাতৃভূমি, তা বকখালি হোক, শুকনা হোক, কিংবা অযোধ্যা পাহাড়ের গাঁকলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছি না। কলকাতাকে বলতে চাইছি বেরিয়ে এসো ইংরেজিয়ানা থেকে—দ্যাখো এই মাতৃভূমি, ভালোবাসো একে, মরবে না। কাদায় ডুবে যাচ্ছে, ধোঁয়ায় দমবন্ধ, কতদিন আর অ্যাংলো-স্যাকসনি মুখোস থাকবে!’’  
সোফায় বসে থাকা নবারুণ ডান পায়ের ওপর বাঁ পা তুলে চশমার কাচ মুছতে মুছতে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন,
‘সন্দীপন যা পড়লেন, মানে অমিয়ভূষণের বক্তব্যটি, আমার মনে হয়, আমরা এখানে যাঁরা আছি তাঁদের এই বক্তব্যটির বার্তা সম্পর্কে কোনও দ্বিমত নেই। আমার তো নেই-ই।’
বলতে বলতে থেমে যান। নীচে কারও পায়ের শব্দ হচ্ছেচেঁচিয়ে বলেন,
‘চে, দ্যাখ তো বাবা কে এল। নীচে আওয়াজ পাচ্ছি’।
বলতে বলতেই ক্রাচ হাতে ঢোকেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বঙ্কিম ওঁর হাত থেকে ক্রাচটা নিয়ে ওঁকে বসতে সাহায্য করেন। নবারুণ সন্দীপনকে বলেন, অমিয়ভূষণের বার্তাটি আখতারুজ্জামানকে পড়তে দিতেওঁর পড়া হলে নবারুণ আবার বলতে শুরু করেন
‘তো, যা বলছিলাম, আমার মনে হয় ইতিহাসের চাকা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে বারবার, বারবার ফিরে ফিরে আসে। তাকে আসতেই হয়। এখানে সবাই আসার আগে বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে আমার কিছু কথা হচ্ছিল। ওই নিজেদের সুখ দুঃখের কথা আর কি। তো, উনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন। কথাটা আমার মনে ধরেছে। উনি বলছিলেন, এই যে আমরা এখন দিল্লিতে বিজেপি সরকারকে দেখছি যারা প্রকৃতপক্ষে আরএসএস বজরং দলের ফ্র্যাঞ্চাইজি করতে এসেছে, এরকম, হুবহু এরকমই একটা ক্ষমতাকে তো আমরা পেয়েছিলাম প্রায় নশো বছর আগে। আমি সেন যুগের কথা বলছি আজকের এই সভার একটা পোশাকি নাম দিয়েছেন সন্দীপন। গৃহীত অন্ধকারেই পথনির্দেশ রচিত হবে। এ বিষয়ে আমার নিজের কিছু কথা আছে। পথনির্দেশ যে চিরকাল অন্ধকারেই রচনা করা হয় এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু সেই অন্ধকার কি আমরা সবাই গ্রহণ করেছি? তা কি আমাদের সবার দ্বারা গৃহীত হয়েছে? মফস্বলের একজন অধ্যাপক নাট্যকারের একটি নাটক দেখতে গেছিলাম মাসখানেক আগে। তো, সে নাটকে একটা জায়গা ছিল যেখানে একটা ছেলে গীটারটাকে স্টেনগানের মতো ধরে চেঁচিয়ে বলছে, যারা আমার মাকে দিনের পর দিন রেপ করেছে তাদের আমি ইয়ে মারি ইয়ে। নাট্যকার ভদ্রলোক আসলে অধ্যাপক তো। শ্রেণিচরিত্র কোথায় যাবে। উনি গাঁড় মারি কথাটা আর স্ক্রিপ্টে লিখে উঠতে পারেননি। এরও কিছু মাস বাদে আমি ওদের রিহার্সাল দেখতে যাইতখন অন্য একটি ছেলে সেই রোলটা প্লে করছে। এবারে দেখি আরও রগড়। এবারে নাট্যকার ছেলেটিকে বলছেন, বল বাম্বু মারি বাম্বু। উনি কিছুতেই গাঁড় মারি কথাটা বলতেই পারছেন না। আমার মনে হচ্ছিল পুরন্দর ভাটকে ওদের রিহার্সালে পাঠিয়ে দিই। কষ্টই হচ্ছিল দেখে। তো এই হল অবস্থা। আমার গাঁড় ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে অথচ আমার ঔপনিবেশিক শিক্ষা ভিক্টোরিয়ান কালচার আমায় তা বলতে দিচ্ছে না। রেক্টাম ফেটে রক্ত পড়ছে, পোঁদে হাত, কিন্তু মুখে ব্রজবুলি। অথচ এরাই কিন্তু এখন নর্মাল মানুষ। যে সাংবাদিকটি প্যারিসে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবকে জুতো ছুঁড়ে মারল তাকেই বলা হচ্ছে লোকটা পাগল। আমার মনে হয় এই পরিবেশে ও-ই একমাত্র সুস্থ সবল লোক আমাদের মধ্যে। আমি তো বলব ওঁর উচিত ছিল দু পাটি জুতোই ছুঁড়ে মারা। ক দিন আগে অক্সফোর্ড বুক স্টোরে গেছিলাম। পার্ক স্ট্রীটে যেটা। অ্যামেরিকা প্রবাসী একজন লেখকের একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। বাটিকাহিনি। ভদ্রলোক এখন সেদেশে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। দেশ ছেড়ে থাকার অনেক বেদনাকাহিনি শোনালেন। অনেকেই তাঁর সাথে গলাও মেলালেনদেশ ছেড়ে যাবার পর দেশ নিয়ে কত ভালোবাসা তাঁর মনে জেগেছে এই আর কি। তো বাপু ছেড়ে গেলি কেন? এই কাজই যদি করবি তো থার্ড ওয়ার্ল্ডেই তার সুযোগ বেশি। এখানে প্রয়োজনও বেশি। কিন্তু না। অ্যামেরিকায় গিয়ে করতে হবেনইলে নাম ফাটবে কি করে। পয়সা আসবে কোত্থেকে। আশ্চর্যের বিষয় সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে এদেশের কোনও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টকে কিন্তু ডাকা হয়নি। এখানে একজন দয়ামণি বারলা কাজ করছেন ঝাড়খণ্ডে। শিল্পপতিদের জঙ্গল পাহাড় কৃষি-ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে লড়ছেন। এখানে একজন প্রীতি পাটেকর কাজ করছেন। যৌনকর্মীর ছেলেমেয়েদের রাত্রিবাস, পড়াশোনা স্বাস্থ্য নিয়ে লড়ছেন। কাশ্মীরে কাজ করছেন সাব্বাহ্‌ হাজি। আসলে আমাদেরকে যে দেশটার ছবি দেখানো হয় বড়ো বড়ো আলো জ্বালিয়ে সেটা আদৌ আমাদের দেশই নয়। সেটা বোধয় কোনও দেশই নয়। সিনেমার শ্যুটিংয়ে যেমন রেইন মেশিন চালিয়ে নকল বৃষ্টিপাত ঘটানো হয় তেমনি এখন উইন্ড মেশিন চালিয়ে সারা দেশে একটা খুশির হাওয়া চালানো হচ্ছে। হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে লেখা রোহিত ভেমুলার চিঠিটা কেউ পড়ার প্রয়োজন মনে করে না। যেখানে সে ভিসিকে বলেছিল, ভর্তির সময় তিনি যেন সব দলিত ছাত্রকে একটা মোটা দড়ি দেন, যাতে তারা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে পারে। সিদা রুকসানাকে এ দেশ চিনতে চায় না। যে মেয়েটা বিষ্ণুপুরাণ নিয়ে পিএইচডি করছে। উড়িষ্যার নিয়মগিরি পাহাড়ে ঢুকতে গেছিল বেদান্তরা। আদিবাসী মেয়েরা কোলে বাচ্চা নিয়ে রাস্তা আটকে দিয়েছে। শিল্পপতিদের গাড়ির সামনে শুইয়ে দিয়েছে কোলের বাচ্চাকেসরাসরি প্রশ্ন করেছে কার অনুমতি নিয়ে আপনারা এখানে এসেছেন? এখানে আমরা ছাড়াও আরও অনেকে থাকে। বনমোরগ থাকে। হরিণ থাকে। বুনো শুয়োর থাকে। প্রজাপতি থাকে। তাদের অনুমতি নিয়েছেন আপনারা? ভাবুন একবারএই সচেতনতা এই প্রতিরোধ ধারণ করে আছেন আমার দেশের মানুষ। এরপর তাঁরা যেটা করলেন সেটা আরও অভাবনীয় এক প্রতিবাদ। জেলা সদরে গিয়ে, ভূমি দপ্তরের অফিসের সামনে রাস্তায় লাইন দিয়ে পেতে দিল জমি অধিগ্রহণের নোটিশআর তার ওপর সবাই ন্যাংটো হয়ে বসে হেগে দিল। এই হচ্ছে প্রতিবাদ। এই হল ভারতবর্ষ। শুরু করেছিলাম যেটা দিয়ে। ইতিহাসের বারেবারে ফিরে ফিরে আসা। ইরানে সেভেন্টি নাইনে ইসলামিক রেভোলিউশন হয়। শাহ্‌কে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে খোমেইনি। এই খোমেইনি কিন্তু একা লড়ে ক্ষমতায় আসেনি। অনেক বামপন্থী গ্রুপ ওকে হেল্প করেছিল। যারা পিকেটিং করেছে। স্ট্রীট কর্ণার করেছেথানা জেল সরকারি অফিস ঘেরাও করেছে। মিছিল করেছেকলেজে কলেজে গিয়ে স্টুডেন্ট মুভমেন্টগুলো অর্গানাইজ করেছেখোমেইনি ক্ষমতায় এসেই কী করলেন? এদের পার্টিগুলোকে দেশে ব্যান করে দিলেন। এদের নেতাদের ধরে ধরে জেলে ঢোকালেন। মৃত্যুদণ্ড দিলেন। নির্বাসন দিলেন। চলতে হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে হবে। হাত মিলিয়ে চলা মানে কী, তা নিশ্চই বলার অপেক্ষা রাখে না। বামপন্থী গ্রুপগুলো থেকে যাতে কোনও বিদ্রোহ বিপ্লব দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য নিয়মিত সামরিক বাহিনীর সাথে আলাদা একটা বাহিনীই উনি তৈরি করে ফেললেন সেই ’৭৯তেই। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরও আছে, বামপন্থী জঙ্গি কার্যকলাপ রোধ শাখা। এই একই ছবি আমরা আমাদের রাজ্যেও দেখেছি। দেখছি। যাদের আন্দোলনে এই সরকার ক্ষমতায় এলো তাদের ঠ্যাঙাতে এখন মাঝরাতে যৌথবাহিনী যায় জঙ্গলমহলে। বন্দীমুক্তি তো হলই না। উলটে এখন যাবজ্জীবন হচ্ছেআর সলমন খান, জয়ললিতারা জামিন পেয়ে যায়। পেরুমল মুরুগানকে থানায় গিয়ে মুচলেকা দিয়ে লেখা ছেড়ে দেবার ঘোষণা করতে হয়। ইতিহাসের এটাই নিয়ম। একবার যা ট্র্যাজেডি পরের বার তাই বেল্লিকবাজার। একটা গান, একটা কবিতা কিম্বা একটা ছবি কিইবা ছিঁড়তে পারে এই সভ্যতারইয়ান জুন, চীনের এই সময়ের একজন কবি ও সঙ্গীতশিল্পী, ওঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন ‘আই ডিমান্ড দ্যাট দ্য হোল অব ম্যানকাইন্ড হ্যাভ দ্য রাইট টু ভোট ফর দ্য প্রেসিডেন্ট অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’। আট-দশ বছর আগে, ব্রিটেনের বিখ্যাত গ্রাফিতি শিল্পী, ব্যাঙ্কসি, যাঁকে আর্ট টেরোরিস্ট বলা হয়, ইস্রায়েলে গিয়ে প্যালেস্তাইনের দিকে থাকা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বিতর্কিত নিরাপত্তা পাঁচিলে ছবি এঁকে এসেছিলেন। এতো এতো বন্দুক, পাহারা, দূরবীন কেউ ধরতেই পারেনি একটা মাথাঢাকা জ্যাকেট আর গেরিলা মুখোশ পরা লোক, হাতে রঙের স্প্রে ক্যান নিয়ে এসে ওদের পাঁচিলে এঁকে দিয়ে গেল ছবি। অসাধারণ ছবি ছিল সেটিইস্রায়েলি নিরাপত্তার বিরাট সেই পাঁচিলের একজায়গায় দুটো বাচ্চা ছেলে খোদাই করে মস্ত এক গর্ত খুঁড়েছে। সেই গর্ত দিয়ে পাঁচিলের ওপারে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের তটভূমি। হাল্কা নীল জল এসে ঠেকছে তীরে। আর নারকেল গাছগুলো ঝুঁকে আছে জলের বুকে। এই পৃথিবীতে একজন ডেঞ্জারাস শিল্পী তো এটাই পারেন, পাঁচিলের ওপারে কী আছে, পাঁচিল ফাটিয়ে সেটা দেখিয়ে দেওয়ার আরডিএক্স তো ধারণ করেন তিনিও। আমি প্রায়শই একটা কথা বলি। আগেও অনেক জায়গায় এটা বলেছি। আমার বাবা এটা বলতেন। ঋত্বিককুমার ঘটককে খুন করা হয়েছিল। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল। সেই খুনের রক্তস্রোতের ওপর দাঁড়িয়ে আমি এখনও সেই কবির লাগি কান পেতে আছি যে আমায় থাবড়ে ঠাণ্ডা করে দেবে।’ 
ঘরে আর কেউ কোনও কথা বলে না। ঋত্বিক নিজের ঠোঁটে চোয়ালে চিবুকে হাত ঘষতে থাকেন। চোখ মেঝের দিকে। শ্বাসাঘাত প্রবণ একটি সশব্দ উচ্চারণ করেন, হুম্‌। সবাই ওঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। নবারুণও। ঋত্বিক কিছু বলবেন বোধ হয়। বিশেষত, নবারুণের দীর্ঘ বক্তব্যের শেষ কটি লাইন ঋত্বিকের মত্যু নিয়েই যেহেতু। এক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু প্রতিক্রিয়া থাকলে সেটা ওঁরই দেওয়াটা স্বাভাবিক। সবাই দেখেন ঋত্বিকের দু চোখে ক্ষোভ ও বিষণ্ণতা তাঁর যমজ সন্তানের মতো দোলে। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে ডান হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করতে করতে ঋত্বিক বলেন, কিন্তু কথা হল, শক্তির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভারসাম্যে সামান্য হেলদোল ঘটলেও সংস্কৃতির বৃত্তে তা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোনও স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। সংস্কৃতি সমাপ্তিহীন এক রেখায় এগিয়ে চলে। সংস্কৃতি হল পূর্বতন সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ। আমরা হুড়োহুড়ি করছি। গুঁতোগুঁতি করছি। দেদার বকে যাচ্ছি। এবং.. এবং দৌড়চ্ছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা বসে আছি। আমরা বসে আছি শুধু একটা নাড়াচাড়ার ওপর।’ 
বঙ্কিম মার্কেজকে বলেন কিছু বলতে। মার্কেজ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকেন। দু হাতে চোখ ঢেকে। একটু পরে, ধরা গলায় বলেন, ‘ঋত্বিক ঠিকই বলেছেন, শক্তির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভারসাম্যে সামান্য হেলদোল ঘটলেও সংস্কৃতির বৃত্তে তা সঙ্গে সঙ্গে কোনও স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। ঠিক। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সোশ্যাল ক্রাইসিসের ভেতর দাঁড়িয়ে আর্ট সবসময় রেসপন্ড করে। চিরকাল করে এসেছে। যদি আর্টকে আমরা একটি লিভিং অবজেক্ট বলে বিশ্বাস করি, তবে তাকে সেই প্রতিক্রিয়াটা সৃষ্টি করতে দেওয়াটা প্রয়োজন। নইলে বলতে হয়, আমরা একটি জীবিত সচল প্রাণবস্তুকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। আসলে, আমি একটা সময়ের কথা ভাবছিলাম। ইদানিং একটা প্রিয় খেলা খুঁজে পেয়েছি আমি। এই ঘরের ডিজিটাল ঘড়িটায় এখন 11 : 19 বাজে। অথচ এটার উলটো দিকে দাঁড়ালেই আমরা একটা অন্য সময়কে পেয়ে যাই। 61 : 11, তার মানে একটা ডিফারেন্ট টাইম জোন আমাদের কাছে পিঠেই নিশ্চয়ই কোথাও আছে। এখানে যখন 01 : 06 তখন ওই টাইম জোনে 90 : 10, ম্যাজিক কতটা হাতের কাছেই রয়েছে। শুধু আমরা একটা প্রি অক্যুপায়েড অবসেশনে থেকে যাচ্ছি বলে সেটাকে ব্রেক করতে পারছি না। এই জাম্পটা শুধু দরকারএকটা লাফ। একটাই। আর আমাদের পৃথিবীর সমস্যাও আসলে একটাই। এটা আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন আমায়। যুদ্ধ জিনিসটা কোনওদিনই যে ভালো কোনও ব্যাপার নয় সেটা সবাই জানে। কিন্তু মুশকিল হল, যুদ্ধ যখন বাধে তখন ভগবান ও তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারা সব সেনাদলে যোগ দেন এবং এক একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হয়ে বসেন।’
মার্কেজ যখন চুপ করে ছিলেন সেই সময়ে ছাদে গিয়ে চে-কে নিয়ে এসেছেন সন্দীপন। চে এখন আখতারুজ্জামান আর সন্দীপনের মাঝখানে চেয়ারের হাতলটায় বসে আছে। সবাইকে দেখছে ঘাড় ঘুরিয়ে। মার্কেজ বলেন ও নাকি চিন্তা করতে পারে। কথাও নাকি বলে মার্কেজের সাথেযদিও অন্য কেউ সেটা দেখেনি। চের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সন্দীপন বলেন, ‘মার্কেজের মুখে সময়ের কথা শুনে একটা ভাবনার কথা মনে এলো আমার। একটা গল্প লিখব ভেবেছিলাম এটা নিয়ে। লিখতে তো কষ্ট হয় খুব, আলসেমিও লাগে। লেখা হয়নি আর। গল্পটা হল এই যে, একটা ছেলে, মফস্বলে থাকে। পড়াশোনায় ভালো বেশ। বিজ্ঞানের ছাত্র। চাকরি-বাকরি কিছু জোটাতে পারেনি। একদিন সে অনলাইনে বিদেশের ছোটখাটো একটা কোম্পানির পরীক্ষায় বসে এবং উতরেও যায়। তারা ওকে প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দেয় এবং জয়েন করতে বলে। আর বলে, তোমার জন্য আমাদের এখানে সারপ্রাইজ রাখা আছে। সেটা এখানে এলে পাবে। প্রথম যখন কেউ আমাদের এখানে আসে তাকেই আমরা সারপ্রাইজ দিয়ে থাকি। তো মফস্বলের ছেলে বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে একদিন চলে যায় দেশ ছেড়ে। এয়ারপোর্টে নেমে যখন সে প্রিপেড ক্যাব ভাড়া করতে যাবে, হোটেলে যাবার জন্য, তখন পেমেন্ট করতে গিয়ে সে জানতে পারে তার সাথে যে কারেন্সি আছে তা এখানে চলবে না। এখানে সবকিছু পেমেন্ট হয় টাইম দিয়েমানে এখানকার লোকেরা চাকরি করে মাসের শেষে সময় রোজগার করে। যার যার অ্যাকাউন্টে তার রোজগার করা সময় ঢুকে যায়। যা কিছু কেনাকাটা, ইলেক্ট্রিক বিল, ফোনের বিল, ট্যাক্সি ভাড়া, হাউজ রেন্ট সব পে করা হয় সময় দিয়েই। এই হল ছেলেটির সারপ্রাইজ। এবারে প্রশ্ন আসে মনে, এতো সময় যে এরা স্যালারি হিসেবে দিচ্ছে, এত এত সময় এরা পাচ্ছে কোথায়? অতীতের পুরনো কারখানা, গুদাম ঘর যেমন ঝোপ জঙ্গল মেখে অব্যবহৃত পড়ে থাকে, তেমনিই নেপোলিয়নের সময়, ষোড়শ লুইয়ের সময়, কিংবা গতকালকের সময়টাও তো এখন আর কারও কাজে লাগছে না। অতীত হয়ে যাওয়া এই সময়গুলোকে নিয়েই তারা লোকজনকে স্যালারিতে দেয়। ফলে, এখানকার লোকেরা বাকি পৃথিবীর থেকে বেশি সময় নিজের কাছে পায়। আপনাকে ধরুন একটা প্রোজেক্ট জমা দিতে হবে। কিন্তু হাতে মাত্র আর দুদিন বাকিটাকা ফুরিয়ে গেলে যেমন লোকে এটিএম থেকে টাকা তোলে বা লোন নেয়, তেমনি কার্ড পাঞ্চ করে সে সময় অ্যাড করে নিতে পারবে বা টাইম লোনও নিতে পারবে। মার্কেজ টাইম জোনের কথা বলছিলেন। আমি বলছি টাইম লোনের কথা। হতে পারে দুটোই হয়ত মার্কেজ কথিত সেই টাইম জোনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ভাষা থেকে বেরিয়ে গেলে তবেই যেমন ভাষামুক্তি ঘটে, এই সময় থেকেও বেরিয়ে যাওয়াটা সেরকম দরকার। সেটাই সময়মুক্তির উপায়আখতারুজ্জামান, আপনার কী মনে হয়?’
আখতারুজ্জামানের চশমার ডান কাচটা ভেঙে গেছে। ভাঙা গুঁড়ো কাচ লেগে আছে কালো ফ্রেমটায়। মাঝে মাঝে একটা দুটো কাচের ছোট টুকরো সেখান থেকে খসে পড়ে। আর তিনি তা কুড়িয়ে রাখেন। ডান হাতের আঙুলে তেমনই কয়েকটা কাচের গুঁড়ো নিয়ে আখতারুজ্জামান বললেন, ‘মিলির হাতে স্টেনগান, এই নামে একটা গল্প লিখেছিলাম অনেকদিন আগেভীষণ রোদের মধ্যে শহরের রাস্তায় একটা মেয়ে সারা গায়ে বোমা বেঁধে হাতে স্টেনগান, সোজা হেঁটে যাচ্ছে, এরকম স্বপ্ন দেখি আজকালআসলে মানুষের পাশে মানুষ থাকলে, মানুষের নিজেকে যদি লোনলি মনে না হয় তাহলে তো তার মাস্টারবেট করার কোনও প্রয়োজন পড়ে না, তাই না?’
সেদিন বিকেল গড়িয়ে যায় আড্ডায়। কথাবার্তায়। মার্কেজ একটা যৌথ উপন্যাস লেখার প্রস্তাবও দেন। মার্কেজের প্রস্তাবনায় যাঁদের নাম ছিল তাঁদের মধ্যে মান্টো আর কমলকুমার বাদে এদিনের আড্ডায় সবাই-ই ছিলেন। আমরা হয়তো কোনওদিন দেখতে পাব সেরকম একটি বা অনেক উপন্যাস।
বিকেলের পর ওঁরা সবাই মিলে হাঁটতে বেরোন দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে। হাইওয়ে। হুশ্‌ করে এক একটা গাড়ি লরি চলে যাচ্ছে। তার মধ্যে সন্দীপন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকেন। আর ছুটন্ত গাড়িগুলো ওঁর ট্রান্সপারেন্ট শরীর ফুঁড়ে চলে যায়। সন্দীপন শিশুর মতো খিলখিল হাসতে থাকেন। চেঁচিয়ে বলেন ‘ম্যাজিক ম্যাজিক’

(চলবে)


No comments:

Post a Comment