নিজের
পাঠক নিজে তৈরি করা, পাঠকের রুচিবদল লেখকের কাজের মধ্যেই পড়ে। জঁরের ছায়ায় থেকে, নামটির আওতায় থেকে, নিজের শক্তি আর আকাঙ্ক্ষার পরিচয় দেওয়া যায়,
ব্যক্তিগত কৃতিত্ব দেখানো যায়, কিন্তু তা স্কিলনির্ভর, সার্কাসের বাঘের মতো।
১৮৫০-এ বাংলায় সাম্রাজ্য বিস্তার করা জঁরগুলো কি আজ ২০১৭-র বাংলা সাহিত্যকে নতুন
কোনো বাঁক আদৌ দিতে পারে? জঁর এসে বাংলা সাহিত্যে যে যুগান্তর এনেছিল, আজ সেটাই
ঘটানো যেতে পারে জঁরকে বিদায় দিয়ে। আজ
আরেকবার ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর মতো যুগান্তর দরকার। বাংলা উপন্যাসের
ধারাকে অমান্য করে প্রায় অন্য একটা পদার্থকে ‘উপন্যাস’ নাম বজায় রেখে আনা অসম্ভব।
আর, তাকে ‘উপন্যাস’ বলতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে কি? কেন একটা লেবেল লাগবে?
‘উপন্যাস’ শব্দটাকে ভুলতে হবে, সেই বিস্মরণ লেখককে এক আশ্চর্য মনঃস্তাত্ত্বিক
মুক্তি দেবে। সম্ভবত, পাঠককে হতাশ ও বিচলিত করার রিস্ক নিতে হবে, সমাজের নীরবতা
কিছুদিন হলেও সহ্য করতে হবে, কারণ ‘উপন্যাস’ ‘কবিতা’ এই শব্দগুলোই পাঠককে অনেক
স্বস্তি দ্যায়, সেটা পাঠককে দিতে হবে কেন, যেন সে একটা বাঁধানো ঘাটে পা ডোবাচ্ছে,
যেখানে অনেক স্নান এবং বাসন মাজার দাগ লেগে আছে?
স্পেসশিপ
থেকে নেমে আসা একটা দোপেয়ে প্রাণীকে দেখিয়ে তো গোরিলা বলা যাবে না, তাকে একটা নাম
দিতে হবে, এবং সেটা আগে থেকেই চালু কোনো নাম হলে চলবে না। যদি বলেন তাহলে কি
দুনিয়ার বাইরের লেখা লিখতে বা পড়তে হবে নাকি, উত্তর হবে- একটা সময় কিন্তু
বাংলাভাষায় ‘উপন্যাস’ আর ‘কবিতা’ শব্দগুলোও ছিল না, ওই ধারণাগুলোও ছিল না। রামপ্রসাদ
সেন বা লালন জানতেন না তাঁরা কবিতা লেখেন, টেকচাঁদ ঠাকুর জানতেন না তিনি উপন্যাস
লিখছেন বাংলায় প্রথম। তাঁরা ওগুলো করেছিলেন ভাষার ভিতর আর বাহিরকে এক
করে দিয়ে। নিবেদিত একজন লেখকের কর্তব্য নিজের পরিবার, নিজের মহল্লা, নিজের
রাষ্ট্রব্যবস্থা, সম্প্রদায়, সমাজ, সংবিধান, জাতীয়তাবোধ, প্রথাগত শিক্ষা,
সংস্কৃতি, পলিটিক্স এই সবকিছুর বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো, তবে তিনি পুরোটা দেখতে পাবেন,
অন্যথায়, কোনোকিছুর মধ্যে অংশ হিসেবে থাকলেই তিনি আচ্ছন্ন হবেন, তাঁর দেখা খণ্ডিত
হবে। এই এলিয়েনেশন ছাড়া কেউ লেখক হয় না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সমকালীন লেখকদের মধ্যে
বড্ড বেশি জড়িয়ে পড়াই দেখা যাচ্ছে, নিস্পৃহ নির্মোহ আত্মকেন্দ্রিক অহংকারী লেখক আজ
অঙ্গুলিমেয়।
যে
সিস্টেমে সো কলড জনপ্রিয় কবিতা থেকে যাবতীয় জ্ঞান, প্রভা, বিদ্যা তুলে নেওয়া
হয়েছে, উপন্যাস থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে সমগ্র সমাজকে ধারণ ও বহন করার ক্ষমতা, সেই
সিস্টেমে তো পাঠক মাথাই ঘামাচ্ছে না কোনটাকে কবিতা বলা হয়, আর কোনটা উপন্যাস! এই
২০১৭-এ বাংলা সাহিত্যকে কতজন ঐতিহাসিকভাবে পাঠ করছেন? নবীনচন্দ্র সেন আর
মন্দাক্রান্তা সেনের প্রভেদ কিন্তু একমাত্র ঐতিহাসিকভাবেই বোঝা সম্ভব। লিটারারি
টার্মগুলোকে যদি ব্রেক করতে হয়, আগে তাদের ব্রেকিং পয়েন্ট স্থির করতে হবে। উপন্যাসকে
লেখক কোথায় ভাঙলেন, সেটা কারা বুঝবে? তারাই সম্ভবত বুঝবে যারা নিজেরা আজ উপন্যাস
লেখার চেষ্টা করছে, অথবা, বাংলা সাহিত্য ঘেঁটে উপন্যাস লেখাটাকে রপ্ত করতে চাইছে।
তাদের ‘উপন্যাস’ অতিক্রম করে তবে তো একজন পাঠক ‘কাজ’-এ আসতে পারবে!
২০১৭-এ
বাংলা সাহিত্যের সিস্টেমের বাহির বলে যদি কিছু কাল্পনিকভাবেও থাকে, সেটা সাহিত্যের
প্রতি আগ্রহহীন জনসাধারণ। তারা জঁরের তোয়াক্কা করে না। তাদের মনঃস্তত্ত্ব বুঝতে
হলে আমাদের বুঝতে হবে কী করে ১৯শ শতকে বটতলা সাহিত্যের রমরমা হয়েছিল, এবং মেলা ও
ফুটপাতে বিছিয়ে রাখা চটি বইগুলো কেন অজস্র বিক্রি হয়। তারা যদি কিছু পড়ে, তাহলে
সেটা ‘কিছু’ বলেই পড়বে, যে কোনো ‘কিছু’ হলেই শ্রেয়, আমার অভিজ্ঞতা অনুসারে। সেটা
পদ্যে লেখা নাকি গদ্যে, স্মৃতিমূলক না অভিজ্ঞতামূলক, যায় আসে না। সেই জনসাধারণ
আগ্রহোদ্দীপক ‘কিছু’ পেলে পড়বে, সেটা পাঁচালি হতে পারে, পলিটিকাল বিশ্লেষণ,
সেলেব্রিটির কেচ্ছা, চুটকি, চোদাচুদির কাহিনি, অথবা ভূতের গপপো। জঁর সিস্টেমের
ভিতর থেকে সেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন অসম্ভব। তারা এখন সিরিয়াল লেখকদের
খপ্পরে, এবং সিরিয়াস লেখকরা সেখানে এলিয়েন।
অনুপম
মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক